অতিথি
তনুজা চক্রবর্তী
ছোট্ট চিনি আজ ভোরেও উঠোন থেকে খালি সাজি নিয়ে ফিরে এল। তাদের গ্রামের বাড়িতে আসার পর তিন-চার দিন ধরে এমনটাই চলছে।
চিনির থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে তার ঠাম্মি বললেন, আজও তোমার আগেই শিল্পীরা হাজির হয়ে গেছে বুঝি? ওরা তো তোমাকে গান শোনাতে আসে, তুমি যে ওদের অতিথি। ওদের দেখে তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেন দিদিভাই?
চিনি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, অতিথি না ছাই, যেভাবে কানের পাশ দিয়ে তোঁ ভোঁ আওয়াজ করে চক্কর দিয়ে যায়, শুনলেই মনে হয় দিল বুঝি হুলের সূচটা ফুটিয়ে। তুমিই গিয়ে ফুল কুড়িয়ে নিয়ে এস ঠাম্মি, আমি আর কোনোদিন যাব না ওই বকুল গাছটার তলায়।
—-সে না হয় যাচ্ছি,কিন্তু তুমি যদি এসব সামান্য সামান্য কারণে ভয় পেয়ে সব জায়গা থেকে সরে আসো, তাহলে তো ভয় তোমার মনের মধ্যে আরো চেপে বসবে। এরপর তুমি যখন একা একা স্কুল-কলেজে যাবে, তখন তো রাস্তা পার হতেই পারবে না। আমি তো দেখেছি তোমাদের কলকাতার বাসায় গিয়ে, বড়বড় বাসগুলো পেট বোঝাই মানুষ নিয়ে কেমন রে রে করে তেড়ে আসে।
চিনি বলল, ওতে আমার ভয় করেনা ঠাম্মি,ওদের তো তোমার শিল্পীদের মত বিষাক্ত হুল নেই। আমার এক বন্ধুকে একবার ফুটিয়ে দিয়েছিল, ব্যথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল। তারপর থেকে ওদের দেখলেই আমার ভয় করে।
—-তোমার বন্ধুটা নিশ্চয়ই ওদের কোনো ক্ষতি করেছিল। কোনো জন্তু-জানোয়ার, কীট-পতঙ্গেরা ইচ্ছে করে কারো ক্ষতি করে না দিদিভাই।
—-মশাদের তো আমরা কোনো ক্ষতি করি না, তাহলে ওরা কেন কামড়ায় ঠাম্মি?
—-সে তো ওদের ডিম জন্মানোর কাজে লাগে বলে মানুষের শরীরে বসে স্ত্রী মশা রক্ত শুষে নেয়। শরীরে প্রোটিনের প্রযোজনে আমরা যেমন মাছ-মাংস খাই, ঠিক তেমনি। ক্ষতি করবে বলে ওরা কামড়ায় না।
চিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, ঠিক আছে সাজিটা দাও, আমি আরও একবার ঘুরে আসি।
সাজি হাতে গাছতলাতে পৌঁছে চিনি চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে খুব মন দিয়ে মাটি থেকে ফুল কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার আর ভয় করছে না। কিন্তু শিল্পীরা কোথায় গেল? ওদের তো আর দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই কোথা থেকে একটা ফড়িং উড়ে এসে গাছটার গোড়ায় গজিয়ে ওঠা একটা ছোট্ট চারার ওপর বসে ডানা দুটো এমনভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগল, যেন চিনিকে নাচ দেখানোটাই ওর একমাত্র উদ্দেশ্য। চিনি ফুল কুড়নোর কথা ভুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। একটা ফিঙে পাখি বকুলের ডাল থেকে লক্ষ্য রাখছিল ফড়িংটার ওপর, একসময় উড়ে এসে ফড়িংটাকে মুখে করে নিয়ে পালানোর আগে একবার তাকিয়ে দেখে নিল চিনিকে। চিনি চিৎকার জুড়ে দিল–ছাড়, ওকে ছেড়ে দে।
পাখিটা ততক্ষণে তার চোখের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। তবে কী এখানে আসার আগে ফড়িংটা পাখিটার কোনো ক্ষতি করে এসেছে?
তার চিৎকার শুনে প্রায় দৌড়ে এলেন তার ঠাম্মি। সব শুনে বললেন, পাখিটা আজ জলখাবার সারবে ওটা দিয়ে, ওদের তো আর মা-ঠাম্মি নেই। নিজেদের খাবার এভাবেই ওদের শিকার করে নিতে হয়। এই একটা বকুলগাছ কতজনকে কতরকম ভাবে সাহায্য করে। গাছ আমাদের সবার বন্ধু।
—-এই দেখ ঠাম্মি, আমাকেও কত ফুল দিয়েছে গাছটা।
চিনির ঠাম্মি বললেন, আর তুমি যাদের ভয় পাচ্ছিলে ভীমরুল, বোলতা, মৌমাছি–তারাও মধু নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেছে। শুধু-শুধু তুমি ওদের ভয় পাচ্ছিলে। ফুল কুড়োতে এসে তুমি কতকিছু দেখতে পেলে, জানতে পারলে গাছ কত উপকার করে। ছুটির পরে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে এদের সবার কথা বলবে তো দিদিভাই?
চিনি বলল, বলব ঠাম্মি, ওদের নিয়ে একটা গল্পও লিখব এবার আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে। তবে, পাখিটার যতই খিদে পাক, ওর ওপরে আমার রাগটা কিন্তু যাচ্ছে না। ফড়িংটা তো অতিথি ছিল। অতিথির সঙ্গে কেউ এমন করে? ঠাম্মির মুখে মৃদু হাসি। মুখে কিছু বললেন না। আপনমনে বিড়বিড় করলেন, আরও কত কি দেখতে হবে দিদিভাই। বুঝতেই পারবে না সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও কেমন বদলে যাচ্ছে।
পাঠকদের মন্তব্য
250