লকাই
সঞ্জিতকুমার সাহা
হরিহর লকাইয়ের কথা একরকম ভুলেই গেছিলেন। প্রতিদিন বাজার থেকে ফেরার পথে তিনি বসন্তর চায়ের দোকানে একটু বসেন। এক কাপ চা হাতে নিয়ে এর-তার সঙ্গে টুকটাক কথা বলেন। বেশিরভাগই বাজার সংক্রান্ত। কী যে দিনকাল পড়ল–লংকা দুশো টাকা কেজি, টমেটো তিনশো, পেঁয়াজ একশো। সমানে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে চাল-ডাল-তেল সবকিছুর দামই। এক জোড়া ডিম চোদ্দ টাকা। তাঁর বয়স হয়েছে। হাঁটাচলা করতেও সমস্যা হয়। তবু নিজেকে সচল রাখতে তিনি বাজারটুকু করেন।
তরুণ বয়সেই দেশোদ্ধারের কাজে একটা এনজিওর সঙ্গে জড়িয়ে যান। গালভরা সব নাম। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন–ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। কাজ হতো সুন্দরবন অঞ্চলের ক্যানিং, বাসন্তীতে। প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র শিশুদের উন্নতিতে নানা ধরনের কাজ করতেন তাঁরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যর দিকেই বিশেষ নজর। এছাড়াও এলাকার পরিবারগুলির আয়-রোজগার যাতে বাড়ে, সেজন্য কৃষি, পশুপালন ও মাছচাষেও সাহায্য করা হতো। কাজটা খুবই ভালো সন্দেহ নেই। কিন্তু বছর কুড়ি-বাইশ চলার পর যাঁরা অর্থ-সহায়তা দিতেন, তাঁরা হাত গুটিয়ে নিলেন। হরিহর বেকার হয়ে গেলেন।
শুধু তাই নয়, কাজপাগল মানুষটা নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে সেই যে ক্যানিং-এ অফিসের পাশেই ঘরভাড়া নিয়ে ছিলেন,সেখানেই থেকে গেলেন। বাড়ির মালিকও তেমনি, তাঁরও তিনকুলে কেউ নেই। সুতরাং ভাড়াটে-মালিক দুয়ে মিলে ভালোই আছেন। হরিহর মানুষটাও সহজ-সরল ও শান্তশিষ্ট। হরিহরকে কাজের সুবাদে এখানে সবাই চেনে-জানে এবং সকলের কাছে শ্রদ্ধেয়। এনজিওতে যেহেতু তিনি শিক্ষা বিভাগটা দেখতেন, সেজন্য অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি। বাড়িতেই সকাল-সন্ধ্যা পড়াতেন। নামেই টিউশন। নির্দিষ্ট কোনও ফি নেই, যে যা দিতে পারে তাই নেন। এভাবেই চলে আর মাঝেমধ্যে একে-তাকে জোর করে ধরে এনে পড়াতে ভালোবাসেন। যেমন লকাইকে ধরে এনেছিলেন।
লকাইয়ের বয়স তখন কত হবে? দশ-বারো। একদিন হাঁড়িহাটায় কী করতে গিয়েছিলেন, সেখানেই দেখেন একটা অল্পবয়সী ছেলেকে কজনে মিলে খুব মারছে। হরিহর সেখানে গিয়ে শুনলেন, ছেলেটি নাকি চোর। সুযোগ পেলেই চুরি করে ফলপাকুড়। সেদিন ওকে আশু সামন্তর ছেলে হাতেনাতে ধরেছে। ওদেরই বাড়ির পিছন দিয়ে ঢুকে গাছে উঠেছিল। তখনই ওকে পাকড়াও করে। হরিহর সেখানে পৌঁছলে, ওঁর কথায় ওকে ছেড়েও দেয় সবাই। তারপর ওকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন তিনি।
এরপর ওর সঙ্গে কথা বলে হরিহর জানতে পারেন, ছেলেটির মা-বাবা কেউ নেই। ওর বাড়িও এখানে নয়। ওরা বাসন্তীর মসজিদবাটিতে থাকত। ওদের জমিজিরেত কিছু নেই। তাই জঙ্গলে, খাঁড়িতে ওর মা-বাবা মাছ-কাঁকড়া ধরতে যেত। একদিন ফেরার পথে, হঠাৎ করে আকাশ কালো করে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হলে, নৌকাডুবি হয়। সেই নৌকায় সেদিন যারা ছিল সবাই জলের তোড়ে ভেসে গেছে অথবা ডুবে মরেছে জানা যায়নি। তবে ওর মা-বাবা আর ফিরে আসেনি। তারপর থেকে কাকার কাছেই ছিল লকাই। কাকার ক্যানিং-এ একটা ছোট্টো দোকান আছে। সেখানেই লকাই থাকে। ফাইফরমাস খাটে।
বেশ চলছিল। কিন্তু কাকী আসার পর থেকেই ওর নিয়ম করে খাওয়াটুকুও জোটে না। কখনও এর-তার কাজটাজ করে দিলে খেতে টেতে পায়। এসব কাকা দেখেও দেখে না। সুতরাং ছেলেটি দিশাহীনভাবে ভেসে চলেছে। তার উপরে কখনও ইস্কুলেই যায়নি। হরিহর তো এমন ছেলেমেয়েদের নিয়েই কাজ করেছেন। পরম যত্নে অক্ষরজ্ঞান দিয়েছেন। কত ছেলেমেয়ে কলেজেও পড়েছে। এখন কেউ কেউ অফিস-টফিসে কাজটাজও করছে। তবে মেয়েরা একটু বড়ো হলে মা-বাবা ইস্কুলে পাঠাত না। ছেলেরাও কোনও না কোনও কাজে ঢুকে পড়ত। তবে চেষ্টা করা হত অন্তত ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত আটকে রাখার।
সুতরাং লকাইকে বোঝানো শুরু হল। হরিহর ওকে সঙ্গে নিয়ে ওর কাকার সঙ্গেও দেখা করেন। হরিহরের ছোঁয়ায় খুব তাড়াতাড়ি ওর অক্ষরজ্ঞান তো হলই, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগও বেশ শিখে গেল। এমনকী খবরের কাগজও পড়তে শিখল। পাশাপাশি চলতে থাকল জীবনের পাঠও। হরিহর তো শুধু অক্ষরজ্ঞান দেন না, মানবিকবোধও ঢুকিয়ে দেন মগজে। বলেন, পড়ার বাইরেও পড়তে হবে। শুধু অ আ ক খ শিখলেই হবে না, এগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। হরিহরের কথাগুলো লকাইকেও ছুঁয়ে যায়।
লকাই হরিহরের বাড়িতে রাখা খবরের কাগজও পড়তে শিখেছে। হরিহর বলতে থাকেন, কারুর কোনও জিনিস না বলে নেওয়া ভালো নয়। যারা না বলে নেয় তাদের চোর বলে। চোরকে সবাই ঘৃণা করে। সৎ হয়ে চললে সবাই তাকে ভালোবাসে। জীবনভর এগুলো মাথায় রাখতে হবে। দেখবি ভাতের অভাব হবে না। হরিহর বেশ তৃপ্ত বোধ করতেন। এভাবেই চলছিল। কিন্তু সাত-দশ মাস চলার পরে লকাই আর আসে না। শেষে আর এলোই না। হরিহর ভাবলেন, এই এখানকার দোষ। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে এটা অভিভাবকেরাও চান না। এদিকে হরিহরেরও ছেলেটিকে বেশ ভালো লেগেছে। টপাটপ ধরতে পারে। কিন্তু না এলে হরিহর কি করবেন?
এরপর হরিহর একদিন লকাইয়ের কাকার বাড়িতে গিয়ে জানলেন, লকাই এখন ক্যানিংয়েই নেই। সুন্দরবনে বেড়াতে আসা এক বৃদ্ধ-দম্পতির সঙ্গে মালদায় চলে গেছে। তাঁদের বড়ো বাড়ি, বাড়ি লাগোয়া বাগান। নানারকম ফলের গাছ, ফুলের গাছ সেখানে। সেগুলো পরিচর্যা করে আর বুড়ো-বুড়ির দেখাশোনা করে । খাওয়া থাকার বিরাট সুযোগ। কাকা খুব খুশি খুশি গলায় বললেন, ওখানে ও এখন দিব্যি আছে। এই তো আমের সময়ে আমরাও গিয়ে ঘুরে এলাম। কত বড়ো বাড়ি! কোনও অভাব নেই। লকাই খুব ভালো আছে।
হরিহরের অতএব করণীয় আর কিছু নেই। তাই ধীরে ধীরে যেমন হয়, লকাইয়ের কথা ভুলেই গেছিলেন। রোজনামচা যেমন চলে তেমনিই চলছিল। কিন্তু আজ সকালে, বসন্তর চায়ের দোকানে যা ঘটল তা একরকম অভাবনীয়। হরিহর বসন্তকে চায়ের দাম মিটিয়ে চলে আসবেন ঠিক তখনই একজন খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে হঠাৎ ঢিপ করে হরিহরকে প্রণাম করে বলল,
ভালো আছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু... হরিহর ঠিক চিনতে পারেন না, কে তুমি?
আমি লকাই।
অমনি মনে পড়ে গেল লকাইয়ের কথা। জিজ্ঞেস করলেন, এখন কোথায়?
এখন এখানে থাকি না। আট-দশ বছর হল মালদায়, এক দাদু-দিদার সঙ্গে থাকি।
তৎক্ষণাৎ হরিহরের মনে পড়ে গেল, লকাইয়ের কাকা একথা বলেছিল।
অনেকরকম কাজ। তবে সবচেয়ে বড়ো কাজ হল, প্রতিদিন দাদুকে খবরের কাগজ পড়ে শোনানো।
হরিহরের চোখদুটো চকচক করে ওঠে। বুকের ভিতরে তখন মাতলার ঢেউ। যে ছেলেটার অক্ষরজ্ঞান ছিল না, যে ছেলেটা লোকের বাগানে না বলে ঢুকে সবেদা পাড়তে গিয়ে ধরা পড়ে চোর হয়ে মার খেয়েছিল, সে এখন একজনকে প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়ে শোনায়। লকাই তখনও বলে চলেছে, জেঠু সেদিন আপনি আমাকে কিছুটা লেখাপড়া শিখিয়েছেন বলেই আমি কিন্তু আজ আমার দাদু-দিদার কাছে নয়নের মণি। বলেন, তোর মতো বিশ্বস্ত ও লেখাপড়া জানা ছেলের আজ খুব অভাব। তোকে কোথাও যেতে হবে না, এখানেই থাকবি। তো ওখানেই আছি।
হরিহর ওর মাথায় আশীর্বাদের হাত ছুঁইয়ে বললেন, এরকমই থাকিস লকাই।
পাঠকদের মন্তব্য
250