ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / জুলাই ২০২৫

চৌকরির চিতাবাঘ

 

এর আগে তোমাদের এই ছোটোদের চাঁদের হাসি ডিজিটাল সংকলনেই বলেছিলাম মায়াবতীর গল্প।  তারপর সেখান থেকে আরো অনেক অল্প-চেনা কিংবা প্রায় অচেনা কত জায়গায় ঘুরলাম! তোমাদের সে গল্পও পরে সুযোগ পেলে বলব। সেইসব জায়গাগুলো ঘুরতে ঘুরতে আমরা মুন্সিয়ারি হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম চৌকরি। উত্তরাখণ্ডের এই জায়গাটি অতি নির্জন আর প্রাকৃতিক দৃশ্য–প্রকৃতি কী যে অবর্ণনীয় সুন্দর এখানে !

অপেক্ষাকৃত বেশি মানুষের বাস যেখানে বা হোটেল ও হোমস্টে যেখানে আছে, সেই জায়গায় পৌঁছনোর আগেই মূল রাস্তা থেকে ঝুরঝুরে এবড়োখেবড়ো পাথরের রাস্তা উঠে গিয়েছে পাহাড়ের ওপরের দিকে।

 

ল্যান্ডমার্ক অবশ্য আছে একটা, গাছপালার ভিতর দিকে একটা টিনের পাতের ওপর লেখা একটা বোর্ড একটুকরো লম্বা কাঠের ওপর আটকানো–রাফাল হোম স্টে। বুকিং করাই ছিল। হোম স্টে থেকে ত্রিভুবন সিং রাফাল রোড ম্যাপ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী ওই ভাঙা পাথরের রাস্তার মুখে এসে গাড়ি থেকে নামলাম আমরা। মিনিট পনেরো অপেক্ষার পর দু’জন এসে আমাদের কিছু মালপত্র হাতে তুলে নিয়ে আমাদের বললেন, "আইয়ে"। বাকি জিনিস নিজেরা নিয়ে ঝুরো পাথরের ওপর দিয়ে উঠতে লাগলাম পাহাড়ের উপরে। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এবার বুঝি গড়িয়ে পড়ে যাব।

 

 

ওদের পিছন পিছন প্রায় ৩০০ মিটার ওঠার পর একটা দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে এক রিঠা গাছের গোড়ায় থামলাম। চারদিকে ঘন জঙ্গল। কিছু পরিচিত আর বেশিরভাগ অপরিচিত গাছ, সবজি আর ফুলের গাছও আছে এদিক-ওদিক। যে ছেলে দু’টি আমাদের নিয়ে এলো, তারা ওই বাড়িটা ঘুরে আরো কিছুটা ওপরে ওঠার জন্য ইশারা করল। আমরা এরপর বাড়ির দোতলায় প্রবেশ করলাম। বাইরে জুতো খুলে ভিতরে যেতে হলো। কারণ, পাশেই নন্দাদেবীর মন্দির আছে, যেখানে ওই ঘরের ভিতর দিয়েই যেতে হয়। তিনটে বেজে গিয়েছিল। তাই আর দেরি না করে লাঞ্চের জন্য আবার একটু নেমে রান্নাঘর লাগোয়া ডাইনিং হলে গেলাম। একদম স্থানীয় খাবার। রুটি আর আচার ছাড়া বাকি ডাল ও সবজি আমাদের কাছে ছিল অপরিচিত স্বাদের।

 

আমরা বাড়িটার ভিতরে ঢুকে ব্যাগগুলো নামিয়েই খেতে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে ঘরে ঢুকতে গিয়ে চারিদিক দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। এর বর্ণনা না দিলে চৌকরির বেড়ানো অর্ধেক বলা হবে না।  একটা বিশাল হলের দুদিকে দুটো ঘর। লাগোয়া বাথরুম। ঘরের চারদিকে কাচের দেয়াল। ভারী পর্দা সরালে একদিকে ঘন জঙ্গল। আর একদিকে জঙ্গল বটে, তবে মানুষের আসা যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে সেখানে। অপরদিকে মোটা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁশের চওড়া মই ঝুলছে দেখা গেল। সামনে তাকালে নীল আকাশের গায়ে তুষারে মোড়া পাহাড় চূড়া।

 

 

কাচের জানলায় চোখ রেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছি চারদিক। হঠাৎ দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে নাম না জানা পাখিরা নেমে এসেছে বাড়িটার একতলার লাগোয়া ঘাসে ঢাকা জায়গায়, যাকে উঠোন বলা যেতে পারে। দেখতে অপূর্ব সুন্দর। তাদের গায়ে কত রকমের যে রং, সে বলে বোঝানো যাবে না।

 

যারা আমাদের নিয়ে এসেছিল, তারা দেখলাম, ওদের জল ও খাবার দিচ্ছে। পাখিগুলো কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছে না মানুষদের। দিব্যি খাচ্ছে, উড়ছে, বসছে, নিজেদের মধ্যে খুনসুঁটি করছে। যত দিনের আলো কমতে থাকল, তত দলবেঁধে পাখি আসতে লাগল। তাদের বকবকানিতে আমরা নিজেদের কথা শুনতেই পাচ্ছিলাম না। আমরাও এরমধ্যে নেমে এসেছি নিচে। দেখলাম, পাখিগুলো আমাদেরও ভয় পাচ্ছে না। সাদা-কালোয় মেশানো একটা খরগোশও ঘুরছিল। এরইমধ্যে জঙ্গলের ভিতরে গিয়েছিল আমাদের একজন। সে আমাদের ডেকে বলল, শিগগির দেখে যাও, ময়ূরের বাচ্চা এখানে। আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি, বিশাল বনমোরগ, প্রায় বাচ্চা ময়ূরের মতোই দেখতে, এক নয়, একাধিক।

 

 

বাড়িটার নিচের তলায় একটা বড় ব্যানার ঝোলানো রয়েছে। এখানে ডিসেম্বর মাসে ‘বার্ড ওয়াচার্স ফেস্টিভ্যাল’ হয়। ছেলেদুটিকে জিজ্ঞেস করলাম, দড়ির মই ঝোলানো কেন। ওরা বলল, পাহাড়ে ট্রেকিং-এ গিয়ে যারা বিপদে পড়ে, তাদের ফিরিয়ে আনতে রেসকিউ টিম যায়। এখানে সেই রেসকিউ টিমের ট্রেনিং হয়। বেশিরভাগ বিদেশ থেকে লোকজন আসে ট্রেনিং নিতে। ভাবছিলাম, কত কিছু আমাদের অজানা রয়ে গিয়েছে। তখনও কি জানতাম, আরও কত কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!

 

বেশ লাগছিল, জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। তার ওপর আবার আমরা চারজন ছাড়া আর অতিথি নেই। নির্জন পরিবেশে খুব ভালো লাগছিল। সন্ধে ঘোর হতে আমরা বাড়ির ভিতর চলে এলাম। এবার ঠান্ডা ভালো করেই জড়িয়ে ধরেছে আমাদের। হলের মধ্যে দুটো চৌকি আছে বিছানা পাতা। আর রয়েছে গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো বসার জায়গা, টেবিল। মাথার ওপর সুদৃশ্য ঢাকা দেওয়া লণ্ঠন, আলো আঁধারি পরিবেশ। পায়ের কাছে সিগ্রি জ্বলছে, পা গরম হয়ে আরাম লাগছে খুব।

 

 

আমরা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসেছি, ইলেকট্রিক কেটলিতে জল ফুটছে। সময় সবে পৌনে সাতটা। একটি ছেলে এলো ডিনারের জন্য ডাকতে। আমরা তখন গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছি। বললাম, খানিকটা পরে গেলে হয় না? ছেলেটি জানাল, অসুবিধে নেই। তবে ও ডাকতে আসবে পরে, তার আগে যেন না যাই। হলের দরজাটা বন্ধ করে দিতে বলল। ভাবলাম, দেরি করে যাব বলেছি তো। তাই খাবার গরম করে ডাকবে বলেই নিশ্চয়ই এমনটা বলে গেল। যাই হোক, আমরা গল্পে মেতে উঠেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। পাহাড়ের মানুষ তো এত রাত জাগে না। খেতে ডাকতে এল না তো। এদিকে আবার না ডাকলে যেতে মানা করেছে !

 

বেশ কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি এলো ডাকতে। বলল, দেরি হয়ে গেল তোমাদের ডাকতে। কারণ, দো তেন্দুয়া (লেপার্ড বা চিতাবাঘ) ইধার ব্যায়ঠে থে। ওউর, ও দোনো আপস মে বাতচিত কর রহে থে। তুম লোগ ডর যাওগে। ইসি লিয়ে বুলায়া নেহি তুম লোগো কো।

আমরা তো শুনে বাক্যহারা। ঘরে আমরা, দরজার বাইরে তেনারা! বাইরে বেরিয়ে জুতো পায়ে গলাতে গিয়ে দেখি বেশ গরম। তেনারা তাহলে জুতোর ওপর বসেই গল্প করছিলেন!

 

রান্নাঘরে একটি অল্প বয়সী মেয়ে রান্না করছিল। তার একটি আড়াই বছর বয়েসী বাচ্চা বিকেলে খেলছিল আমাদের সঙ্গে। এখনো দেখি বাচ্চাটি বাইরে ঘুরছে। জানতে চাইলাম, বাচ্চাটা বাইরে ঘুরছে, ভয় করছে না আপনাদের? এই প্রশ্নের উত্তরে ওরা কী বলল জানো ?

বলল, লেপার্ডের স্বাভাবিক খাদ্য তো মানুষ নয়। এই জঙ্গলে ওদের অনেক খাদ্য আছে। তবে ওরা মানুষ মারবে কেন ? আর আমাদের ওরা চেনে।

 

পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে আমরা জঙ্গলের একটু ভিতরে গিয়ে ছবি তুলব বলে এগোচ্ছি, তখন একজন বলল, একটু আগেও তিনটে তেন্দুয়া কাছাকাছি ছিল। একটু পরে যাও। এখনো পাখির কলতানে প্রকৃতি মুখর হয়ে আছে। যে ছেলেটির সঙ্গে কাল থেকে সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে, সে অনেক পাখির নাম আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে গেল। কিন্তু এই ব্যাপারে আমার কোনো জ্ঞান নেই, তাই ওদের রূপেই মুগ্ধ হয়ে রইলাম।

 

 

প্রাতরাশ সেরে ফেরার পথ ধরতে হবে। রাফালজির সঙ্গে দেখা হবে কিনা জানতে চাইলাম। ফর্সা রোগা ছোটখাটো চেহারার ছেলেটি জানাল, সে-ই ত্রিভুবন সিং রাফাল। এবার আমাদের বিস্ময় তুঙ্গে। কারণ, আমরা জেনেছিলাম, এই যে একটা বিশাল পাহাড়, ঘন জঙ্গলে ঢাকা, এই জঙ্গলটা রাফালজি একার চেষ্টায় ছাব্বিশ বছর ধরে গড়ে তুলেছে। এই জঙ্গলের একটি গাছের ডাল কাটতে হলেও সরকার তথা পঞ্চায়েত থেকে রাফালের সহযোগিতা নেয়। পাহাড়-জঙ্গল-বন্যপ্রাণ অন্ত প্রাণ ত্রিভুবন সিং রাফাল যে এত মাটির কাছাকাছির মানুষ, ভেবে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। একটা খুব সুন্দর দিন আর রাত কাটিয়ে এলাম, যা কিনা আমাদের এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। ট্রেনে কাঠগোদাম নেমে নৈনিতাল বা মুন্সিয়ারি থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া চৌকরিতে। খোঁজ-খবর নিয়ে তোমরাও ঘুরে এসো একবার।


পাঠকদের মন্তব্য

তনুজা চক্রবর্তী লিখেছেন... ১৪ই জুলাই, ২০২৫
খুব ভালোলাগল, চৌকরিতে মন চলে গেছিল কিছু সময়ের জন্য।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up