ছত্তিশগড়ে এক টুকরো তিব্বত
লিপি চক্রবর্তী
তিব্বত বলতেই আমাদের মাথায় আসে লাসা শহরের কথা আর তোমরাই বলো, লাসা মানেই গাবলু-গুবলু সাদা পশমে ঢাকা ছোট্ট কুকুরের কথা মনে আসে কিনা ! ভারতের ছত্তিশগড় জেলায় এক টুকরো তিব্বতেও কিন্তু তাদের দেখা পাওয়া যায়। সম্প্রতি ঘুরে এলাম এই অঞ্চলটিতে। বেড়ানোর গল্প বলার আগে ছোট্টো একটু ইতিহাস। ১৯৫৯ সালে তিব্বতে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতির কারণে তিব্বতীদের একটি দল ভারতের এই অঞ্চল, যা বর্তমানে ছত্তিশগড়ের মেইনপতে বলে খ্যাত, সেখানে চলে আসে। ১৯৬২-৬৩ সালে এখানে অনেকগুলো তিব্বতী কলোনি গড়ে ওঠে। মেইনপতে তাঁদের বাসস্থানের এবং চাষের জন্য জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ঝরনা, জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা সেই মেইনপতে তিব্বতীরা দারুণ পর্যটক আবাস গড়ে তুলেছে দেখলাম।
হাওড়া থেকে রাতের আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে (রাত ৯.৫৫) চড়ে ভোরে পৌঁছলাম ঝাড়শুগুদা স্টেশনে। এখানে গাড়ির স্ট্যান্ড আছে। সেখান থেকে গাড়ি ঠিক করে চললাম মেইনপতের দিকে। ওড়িশা থেকে ছত্তিশগড়ের সীমানায় ঢুকতেই পরিবেশ পাল্টে গেল। মসৃণ হাইওয়ের দু'ধারে ঘন পলাশের জঙ্গল। গাছে আর পাতা নেই, শুধু ফুলে ভরে আছে। রাস্তায় পেলাম 'শাদিবালে মন্দির'। মন্দিরের ভিতরে রাধাকৃষ্ণ আছেন, বাইরে আছেন শিবঠাকুর। মন্দিরের পিছনে বিশাল চওড়া এক নদী। গাড়ির চালক ভাই তার নাম বললেন ইভ। এখন জল কম। এরপর যশপুর জেলার বাগিচা (পাহাড়ের ওপরে পাখিদের ঘরবাড়ি) হয়ে রাজপুরী ঝরনা। এই ঝরনা প্রায় সত্তর মিটার ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, চলে গিয়েছে নিরুদ্দেশে।
এরপর টাইগার পয়েন্ট। মহাদেব মুড়া পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে এই ঝরনা গভীর খাদে লাফিয়ে নেমেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, একসময় এখানে নাকি বাঘ আসত জল খেতে। চারদিকে ঘন জঙ্গল। বাঘ তো আসতেই পারে। পাহাড়ের দুধারে ধাক্কা খেতে খেতে যদি পাথরের সিঁড়ি ধরে ঝরনার একদম পায়ের কাছে নামতে পারো, তবে দেখবে, কী অপরূপ সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য। নামতে না পারলে ওপর থেকেও ঝরনার সৌন্দর্য দেখতে পারবে। দোলমা টিবেটিয়ান রিসর্ট টাইগার পয়েন্ট থেকে বেশ কাছেই। এখানেই আমাদের রাত্রিবাস। রিসর্টের ভিতরে ঢুকেই মন ভালো হয়ে যাবে–কত রকমের যে ফুল আর তিনটি ভারী দুষ্টু-মিষ্টি কুকুরকে আপ্যায়ন করতে দেখে। পরিবেশ খুব সুন্দর। সামনেই ঢেউ খেলানো টিলার সারি। পাশে শান্ত ও সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত এক বৌদ্ধ মন্দির। স্কুল, হাসপাতাল, প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র, অন্যান্য রিসর্ট, ঘরবাড়ি ছবির মতো সাজানো। সর্বত্র পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট।
পরদিন ভোরে যখন বেড়াতে বের হলাম, বাতাসে তখনও শীতলতা যথেষ্ট। এখানে ভূপ্রকৃতির দুটি অদ্ভুত খেয়ালের দেখা পাওয়া যায়। প্রথমটি জলজলি পয়েন্ট বা বাউন্সিং ল্যান্ড। রাস্তা থেকে খানিকটা সিঁড়ি নামলে একটা বিশাল সবুজ মাঠ। সে মাঠ বেশ অদ্ভুত–স্পঞ্জের গদির মতো। একটু লাফিয়ে উঠলে সেই মাঠ আরও একটু ঠেলে তুলে দিচ্ছে ওপরের দিকে। আশেপাশে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরাও দুলে উঠছেন। সে এক মজার ব্যাপার। দেখলাম, ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বড়রাও আনন্দে মেতে উঠেছে। আর আছে বিসরপানি গ্রামে উল্টাপানি। জল বইছে পাহাড়ের নিচ থেকে উপরের দিকে। সবাই শুকনো পাতা, কাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ভাসাচ্ছে আর সেটা ভেসে চলেছে ঢালের বিপরীতে। যদিও অনেকেই একে অপটিক্যাল ইলিউশন বলেছেন।
এরপরের গন্তব্য মছলি পয়েন্ট বা ফিশ পয়েন্ট। কালচে সবুজ রঙের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গেলাম ফিশ পয়েন্টের মাথায়। এটিও একটি ঝরনা। পাহাড়ের গভীর খাঁজ থেকে বেরিয়ে এসে এক জলাশয় তৈরি করে, আবার চলে গিয়েছে অনেক নিচের অন্ধকারে। সেই জলাশয়ে ঘুরছে রঙিন ছোট ছোট মাছ। চারদিকে পাহাড় ঘেরা নির্জন জঙ্গল। চালকভাই বললেন, বিকেল বা সন্ধের সময় হাতি নামে এখানে। এদিন আর এক বিস্ময়ের কাছে গেলাম–নাম ঠিনঠিনি পাত্থর। একটি বিশালাকায় সাদা পাথর। তার গায়ে ছোট্ট পাথর দিয়ে অল্প আঘাত করলে তারের বাজনার মতো শব্দ হচ্ছে। অথচ আরও পাথর ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। তাদের গায়ের পাথর লাগলে কোনও ধাতব আওয়াজ বের হচ্ছে না। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেয়াল !!
উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা, ঘন জঙ্গল, রাস্তায় অসংখ্য বাঁদরের ছুটোছুটি, সবুজ উপত্যকা–দেখেশুনে মন ভরে গেল আমাদের। রিসর্টে ফিরে একটু বিশ্রাম। তারপর সন্ধে নামার আগেই পৌঁছে গেলাম পারপাতিয়া বা সানসেট পয়েন্ট। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। শেষবেলায় একটা মজার তথ্য জানাই–এটি কিন্তু হিমালয় নয়, বিন্ধ্য পর্বত। শীতে এখানে কখনও কখনও বরফ পড়ে। আর বর্ষায় ফোটে অজস্র রঙিন ফুল। দুটি দিন ঘুরে আসতেই পারো তোমরা। আসা-যাওয়া-থাকার যাবতীয় খবরের জন্য ইন্টারনেটে মেইনপত সার্চ করলেই সব তথ্য জানতে পারবে।
পাঠকদের মন্তব্য
250