পাহাড় আর ঝর্নায় নান্দনিক শিলং
মহুয়া দাস ভট্টাচার্য
বর্ষা যেতেই শরতের নানা অনুষঙ্গ আমাদের উদ্বেল করে দেয় ! আর শরৎ মানেই তো পুজো আর পুজোর ছুটি। হাতে একেবারে সময় নেই। তাই এবার ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়, এখনই পরিকল্পনা করে ফেলতে হবে !! তোমরা যারা পাহাড় ভালোবাসো, তাদের জানাই পুজোর ছুটিতে ঘুরে আসতে পারো অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা এক পাহাড়ী শহরে। সেখানে দেখবে সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণি থেকে ভূমিতলে ধাবমান ঝর্ণা, সারি সারি পাইন বন, ঋতুতে ঋতুতে মরশুমি ফুলের বাহারী সমারোহ আর পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছবির মতো সাজানো বাড়ি। এককথায় অপূর্ব ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। খাসি, জয়ন্তিয়া ও গারো–এই তিন পাহাড় নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের এই রাজ্যটি। শিলংয়ের উচ্চতা ১,৫২৫ মিটার।
ভারতের অন্যান্য শৈল শহর থেকে শিলং বেশ কিছুটা আলাদা। শহর ঘিরে আছে সবুজ অরণ্য ! এই অঞ্চলের আবহাওয়া বেশিরভাগ সময়ই থাকে মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা। তার থেকেই মেঘালয় নামকরণ! বলা বাহুল্য প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয় পুরো রাজ্য জুড়ে। মেঘালয় হলো অর্কিডের স্বর্গ। শিলং শহরও তার ব্যতিক্রম নয়। নানা প্রজাতির অর্কিড দেখতে পাওয়া যায় এখানে। এছাড়াও আছে পাইন, ইউক্যালিপটাস, রডোডেনড্রন, দারুচিনি ও এক বিশেষ ধরনের বাঁশগাছ (হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি হয়) এবং আরও নানা প্রজাতির গাছপালা। ফুল ও ক্যাকটাসের শোভায় সাজানো এই সুন্দর শহর।
শিলংয়ে রয়েছে অজস্র ঝর্না, সৌধ ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান, যা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা অবসর কাটাতে আসত এই শহরে। শিলং শহরকে ভালোবেসে ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড‘ নামকরণ করেছিল তারা। আজও ব্রিটিশদের তৈরি কান্ট্রিহাউস দেখতে পাওয়া যায়, যা কালের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে। শিলংয়ে, মিশনারীদের প্রভাব খুব বেশি। তাই, অধিকাংশ মানুষই খ্রিস্টান। এখানকার চার্চগুলিতে সেই মিশনারী স্থাপত্য, সৌকর্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় প্রিয় ছিল এই শহর। শিলংয়ে তাঁর প্রথম সফরে এসে রিলবং এলাকার একটি বাংলো ব্রুকসাইডে তিন সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত সেই বাংলো আজও পাইন এবং ইউক্যালিপটাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।
শিলং শহরে পৌঁছনোর আগেই পথে পড়বে উমিয়াম লেক, যা প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করে। খাসিয়া ভাষায় উমিয়াম শব্দের অর্থ চোখের জল। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এক না-ভোলা অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরে নিতে ভুলো না ! শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিলং পিক, এর উচ্চতা ৬৪৪৯ ফুট। এটি মেঘালয়ের উচ্চতম পয়েন্ট। এখান থেকে দৃশ্যমান মনোরম শিলং শহর। দেখা যায় সুউচ্চ পাইন বনের সারি। শিলংয়ের বিখ্যাত পুলিশ বাজার এলাকায় রয়েছে হোটেল, রেস্তোরাঁ, বাস টার্মিনাস, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ইত্যাদি। পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম সেরা এলিফ্যান্ট ফলস, যা শিলং পিক থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এই জলপ্রপাত রাজ্যের সব থেকে বড় এবং অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।
এছাড়াও আপার শিলংয়ের ইস্টার্ন এয়ার কমান্ড মিউজিয়াম দর্শনীয় স্থান। শিলংয়ে এলে দেখতেই হবে লেডি হায়দারি পার্ক, ওয়ার্ডস লেক। আর যেটা না দেখলে শিলং বেড়ানো অসম্পূর্ণ, সেটা হলো গলফ কোর্স। ৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত অনন্য সুন্দর এই গলফ কোর্স এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম। শহরের ৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দুই জোড়া ফলস–বিডন আর বিশপ। এদের বৈশিষ্ট্য, একই পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এই দুই জলপ্রপাত। চার্চের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বিশেষ করে বলতে হয় ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল চার্চের কথা। এর অভিনব স্থাপত্যশৈলী সহজেই নজর কাড়ে। যিশুখ্রিস্টের জীবনের নানা কাহিনি ও উপাখ্যান দেওয়ালের গায়ে তৈলচিত্রের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সুইট ফলসও দেখে আসতে পারো ।
আপার শিলং ছাড়িয়ে শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে আছে মাফলং বা মাওফ্লাং গ্রোভ। অপরূপ এক তৃণভূমি। স্থানীয় উপজাতি মানুষদের কাছে এটি একটি ‘পবিত্র অরণ্য’। মেঘালয়ের আরেকটি অনির্বচনীয় স্পট হলো, মৌসিনরাম। এখানে যাবার পথেই পড়বে মাওফ্লাং গ্রোভ। প্রসঙ্গত, শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে চেরাপুঞ্জি। আগে সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের জন্য বিখ্যাত ছিল চেরাপুঞ্জি। বর্তমানে সেই খ্যাতির পালক মৌসিনরামের মুকুটে, যা চেরাপুঞ্জি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। শিলং থেকে এর দূরত্ব ৬৯ কিলোমিটার। এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১,৮৭২ মিলিমিটারের বেশি।
কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গুয়াহাটি বিমানবন্দর, সেখান থেকে শিলং পৌঁছতে ১২৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। কমবেশি চার ঘণ্টা সময় লাগে পৌঁছতে। এছাড়া হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সরাইঘাট, কামরূপ, গুয়াহাটি-গামী এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো ছাড়ে। গুয়াহাটি রেলস্টেশন থেকে শিলং শহরের দূরত্ব ১০৩ কিলোমিটার। স্টেশন বা বিমানবন্দর থেকে সরকারি-বেসরকারি লাক্সারি বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে শিলং যাওয়া যায়। থাকার জন্য প্রচুর ছোট-বড় হোটেল আছে এখানে। আছে হোমস্টে-ও। খবরাখবর জানতে যোগাযোগ করতে পারো মেঘালয় ট্যুরিজম (Meghalaya Tourism)-এর সঙ্গে। সারা বছরই শিলং যেতে পারো। তবে, মার্চ থেকে জুন সবচেয়ে ভালো। আর শীতে গেলে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নিয়ে যেও অবশ্যই।
◾ছবি ঋণ ইন্টারনেট
পাঠকদের মন্তব্য
250