ছোটোদের চাঁদের হাসি / জেনে নিতে মানা নেই / জুলাই ২০২৫

পাখিদের ঘরবাড়ি

 

মানুষদের থাকবার জন্য একটা আস্তানা চাই। সে প্রাসাদ হোক, অট্টালিকা হোক, পাকা দালানবাড়ি হোক বা খড়-মাটির, টিন-টালির ঘর হোক বা নিতান্ত ঝুপড়ি–মাথা গুঁজবার একটা আস্তানা চাই-ই। যারা উদোম আকাশের নিচে ইঁট-পাথরের শয্যায় চট-মাদুর, ছেঁড়া কাঁথা বিছিয়ে রাত কাটায়, তারাও স্বপ্ন দেখে নিজস্ব একটা বাসা-বাড়ির।

      ছোটবেলায় একটা কবিতায় ছোট্ট পাখি বাবুই-এর ‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচাঘর খাসা’ সদর্প উক্তির কথা আমরা জানি। নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে থাকার আনন্দই আলাদা। রোদ-ঝড় বৃষ্টি-বাদল যতই ঝাপটা দিক, তবু নিজের ঘর নিজের বাসা।

         বাবুই পাখির বাসাকে হাওয়ায় নড়তে দেখে বিদ্যাসাগর মশাই তো ছড়া কেটে ফেললেন–‘পাখির বাসা হাওয়ায় নড়ে’। রবীন্দ্রনাথও ‘পাখিরা যায় আপন কুলায়’ লিখে পাখির বাসাকে একটা গানে মূর্ত করে রাখলেন। এমন অনেক উদাহরণ বইয়ের পাতা ঘাঁটলে এখনো পাওয়া যাবে।

           কীটপতঙ্গ পশুপাখি সবাই বাসা চায়। সবার কপালে যে বাসা জোটে তা নয়। যে সব পাখিরা বাসা বানিয়ে সংসারধর্ম পালন করে–সেইসব পাখিদের নিয়েই দু-চার কথা।

 

          শালিক,চড়ুই,বুলবুলি আমাদের খুব পরিচিত পাখি। ডিম পাড়ার সময় হয়ে এলেই পাখি বাসা বানায়। ওড়াওড়ি করে প্রথম কয়েকটা দিন চলে জায়গা নির্বাচনের কাজ। বাসা বানাতে তো একটা মনমতো সুরক্ষিত জায়গা চাই ! মার্চ মাস পড়তেই বুলবুলি পাখিরা কেমন ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ওঠে। বনবাদাড়ের ঝোপঝাড়, কোণা-কানচি, বাগানের কোনো ঝোপওলা গাছের ফাঁক দিয়ে গোল মাটির মতো বাসা তৈরি করে বুলবুলি। বাসা তৈরি করতে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। ডিমগুলো যাতে নিরাপদে থাকে, ডিমে তা দেওয়ার সময় যাতে একটানা দিন কয়েক নিরাপদে থাকা যায়, বাচ্চা ফুটে বেরুলে, বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে বাচ্চাগুলোকে মানুষ করা যায়–যতক্ষণ না নিজেরা উড়তে শিখে স্বাবলম্বী হচ্ছে–ততক্ষণ বাসাটাই অগতির গতি। তারপর, সেই বাসাটার দিকে ফিরেও তাকায় না।

 

           আবার শালিক পাখি, একটা আনাচ-কানাচ দেখে, এমনকী গৃহস্থের বাড়ির একটা কোনা-কানচিতে যাওয়া-আসা করা যায়–এমন ফোঁকড় পেলেই যত রাজ্যের লতাপাতা, পালক, শুকনো খড়, ডালপালার টুকরো, পশম যা কিছু হাতের সামনে পায় নিয়ে এসে সেই জায়গায় জড়ো করে। একটু গদির মতো হলে পা দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে ঢালু করে নিয়ে থাকবার মতো বাসা তৈরি করে। এদের বাসা তৈরিতে কোনো শিল্পকলা নেই, সৌন্দর্যের বালাই নেই, থাকতে হয় তাই। প্রয়োজন মেটানো যাকে বলে।

          চড়ুই পাখি তো ঘুলঘুলি, বাসাবাড়ির ভেতরের ফাঁক-ফোঁকড়ে থাকতে ভালোবাসে। এদের বাসা যৎসামান্য খড়কুটো দিয়ে তৈরি হয়। বাসার ছিরিছাঁদ নেই। তবে চড়ুই ও শালিক পাখি একই বাসায় ঘুরে-ফিরে আসে ও থাকতে ভালোবাসে। বুলবুলি প্রয়োজন ফুরোলেই সাধের বাসাকে টা-টা বাই-বাই করে।

 

         

বাসা তৈরি করতে কোন পাখি কত সময় নেয়, সেটা নির্ভর করে বাসা তৈরির মালমশলা জোগাড়ের উপর। সাধারণত পুরুষ-পাখিরাই যোগাড়যন্ত্রের কাজে ব্যস্ত থাকে, স্ত্রী-পাখিরা বাসা তৈরির সরঞ্জামগুলোকে সাজিয়ে-গুছিয়ে বাসা তৈরি করে। আবার বাসা তৈরি হয়ে গেলে, ডিম পাড়ার কাজটি হয়ে গেলে, পুরুষ-পাখিটি স্ত্রী-পাখি ও বাসাকে পাহারায় রাখে।

          বাসা তৈরির ব্যাপারটা আবার নির্ভর করে দেশ-কাল পাত্রের উপরও। যেখানে সহজেই খাবার-দাবার মেলে এবং নিরাপত্তাও মেলে তেমন জায়গা পাখিদের পছন্দ। ডালপালা-শুকনো পাতা দিয়ে ঈগল বাসা বানায় উঁচু পাহাড়ের খাঁজে–চত্বর গহ্বরে। পেঁচা, কাঠঠোকরা সাধারণত গাছের কোটর বা ফাঁক-ফোঁকড়ে বাসা বানায়। টুনটুনি আবার পাতায় পাতায় সেলাই করে ঠোঙা বা থলের মতো বাসা বানায়। বাবুই পাখি তাল-নারকেল গাছের মাথায় পাতার অংশ দিয়ে উল্টো কলসের মতো, পেনডেন্টের মতো ঝুলানো বাসা বানায়। ভারী সুন্দর বাসা। শিল্প ও সৌন্দর্যের মিশেল, সাধে কি আর বাবুইকে টেলর-বার্ড বা দর্জি-পাখি বলে!

 

        আবার যে সব পাখিরা উড়তে পারে না, তারা মাটির উপরে থাকবার জায়গা তৈরি করে। অস্ট্রিচ পাখি, পেঙ্গুইন ইত্যাদি। জলচর পাখিরা জলাশয়ের কাছাকাছি ঝোপঝাড়ে বা পাড়ে মাটির গর্তে বাসা বানায়। হাঁস জাতীয় জলচর পাখিরা আবার কেউ কেউ শ্যাওলা-দাম, কচুরিপানা, ভেসে আসা লতাপাতায় বাসা বানানোর কাজটি সেরে নেয়। মাছরাঙা জলার ধারে কাদার গর্তে বাসা বানায়।

          কাক গাছের ডালে শুকনো ডালপালা দিয়ে সাধারণত বাসা বানায়। তবে কাকের বাসায় টুকরো দড়িদড়া, প্লাস্টিক এমনকী সাপের খোলসও  কখনো কখনো পাওয়া যায়। চামচ, সাবান কেস, দু-এক টুকরো সাবানও মেলে কখনো-সখনো। এক জাতের পাখি আছে, যারা উঁচু পাহাড়ের গায়ে মুখের লালার সাহায্যে বাসা বানায়। এহেন লালা-নির্মিত বাসা নাকি উপাদেয় খাদ্য হিসাবেও ব্যবহৃত হয়।

 

          পরিযায়ী পাখিরা গাছের ডালে, জলার ধারে বাসা বানিয়ে বসবাস করে। ডিম পাড়া থেকে বাচ্চা বড়ো করার সব কাজ সেরে নিয়ে এরা বেশির ভাগই পুজোর আগে নিজের দেশে উড়ে যায়। কিছু পাখি অবশ্য জায়গাটাকে ভালবেসে থেকে যায়। পরিযায়ী পাখিরা খুব কম সময়ে বাসা বানানোর কাজটি সেরে নেয়।

 

      

কিছু পাখি আছে, যারা মানুষের মতো দোতলা ঘর বানায়। দোতলা থাকবার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করে, একতলাকে পাহারা ঘর হিসাবে ব্যবহার করে। কিছু কিছু পাখি আছে ঝাঁকে ঝাঁকে একসাথে থাকতে ভালবাসে। ঝোপঝাড়ের ফাঁক-ফোঁকড়কেই এরা বাসা হিসাবে ব্যবহার করে। বাসা বলতে কিছু খড়কুটো, লম্বা ঘাস দিয়ে বাজারের থলের মত বাসা বানায় ওয়ার্বলার পাখি। এশিয়া, আফ্রিকার গরম এলাকায় ধনেশ পাখি দেখা যায়। মোটা গাছের গুড়িতে কোটর তৈরি করে এরা বসবাস করে। এদের বাসায় আতুরঘর আছে। ডিমপাড়া হয়ে গেলে স্ত্রী ধনেশ পাখি কোটরে বসে থাকে, ডিমে তা দিতে। পুরুষ পাখিটি কাদামাটি এনে কোটরের মুখ বন্ধ করে দেয়–একটু গোল মতো ফাঁক রেখে। যাতে শ্বাস-প্রশ্বাস ও খাওয়া-দাওয়ার কাজ ওই ফাঁক দিয়ে সারা যায়।

       

        আবার কিছু পাখি আছে বেশ সময় নিয়ে বাসা বানায়। ছোটো পাখিদের ক্ষেত্রে চার থেকে দশ দিনের মধ্যেই বাসা তৈরির কাজটা শুরু হয়ে যায়। পেন্ডুলিন ট্রিটপাখি আর বুটিল গোলাকার বাসা তৈরি করতে সময় নেয় প্রায় দেড়মাস। সোনালি ঈগলের সময় লাগে প্রায় দু’মাস। আর সুইফট লেয়াটের সময় লাগে প্রায় তিনমাস।

         কিছু কিছু পাখির বাসা আবার গোল বলের মতো। মুনিয়া, পেন্ডুলাইন টিট, ফ্লেমিংগো পাখি বাসা তৈরি করে কাদামাটি দিয়ে। বাবুই পাখির মতো শিল্পকর্মে ঠাসা এই পাখির বাসা। মানুষদের মতো পাখিদেরও সমবায় আবাসন বা হাউসিং এস্টেটের মতো এলাকার বাসায় হাজার হাজার পাখি একসাথে থাকে। পাখির বাসা বহু বিচিত্র। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পক্ষীবিশারদ ভারতের সেলিম আলি মোটামুটি দশ ধরণের বাসার কথা বলেছেন। সমতল, পাহাড়, জলাভূমি ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় পাখিদের বাসাবাড়ি সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন।

     ঘুলঘুলি, কার্নিশ  বা ফাঁক-ফোঁকড়ে  বাসা করা শালিখ, চড়ুইযের ছোট্ট বাসাগুলোকে অনেকেই নির্মমভাবে ভেঙে দিয়ে উৎপাত থেকে রেহাই পেতে চান। মানুষের অত্যাচারে কত পাখি যে গৃহছাড়া হয়ে, উৎখাত হয়ে হারিয়ে যায়–তার খোঁজ কে রাখে ! বৃক্ষছেদন করে যেভাবে বনভূমি গ্রাস করা হচ্ছে, ভয় হয়, নীল আকাশে পাখিদের উড়ে যাবার দৃশ্য তেমনভাবে আর দেখা যাবে কি!

 

ছবি ঋণ ইন্টারনেট


পাঠকদের মন্তব্য

নীতীশ বসু লিখেছেন... ১৩ই জুলাই, ২০২৫
অনেককিছু জানা গেল । ভালো লেগেছে ।
তনুজা চক্রবর্তী লিখেছেন... ১৪ই জুলাই, ২০২৫
পাখিদের ঘরবাড়ির কথা জেনে খুব আনন্দ পেলাম।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up