ভারতে ছাপাখানা এলো কীভাবে?
গৌতম হাজরা
তোমরা যে এখন ছাপার অক্ষরে বই পড়ছো, সেইসব ছাপা বইয়ের প্রচলন বহু বছর আগে কিন্তু ছিল না৷ আমাদের দেশে তখন হাতে লেখা পুঁথির প্রচলন ছিল। যাঁরা পুঁথি লিখতেন, তাঁরা পেতেন মোটা পারিশ্রমিক। বিনিময়ে লিখতে হতো চমৎকার ছাঁদের অক্ষরে পাতার পর পাতা৷ আকবর, জাহাঙ্গীরের আমলে তৈরি যেসব রাজকীয় পাণ্ডুলিপি এখন মুদ্রণযন্ত্রের দৌলতে আমাদের সামানে তুলে ধরা হচ্ছে, সেদিন কিন্তু ওইসব পান্ডুলিপির এক একটা পাতা ছিল স্বতন্ত্র, যেন জীবন্ত ছবি৷
দিন যত এগোতে থাকলো, হাতে লেখা পুঁথির প্রচলনও কমতে শুরু করল৷ হাতে লেখা পুঁথির বদলে এল ছাপাখানা। এই ছাপাখানা প্রথম চালু হয়েছিল জার্মানিতে। আবিষ্কার করেছিলেন জোহান্স গুটেনবার্গ, ১৪৪০ সালে। যতদূর জানা যায়, জার্মানির মিউনিখে গুটেনবার্গ প্রেস থেকে ছাপাখানার জয়যাত্রা শুরু৷ তারপর ধীরে ধীরে গোটা ইউরোপ ছেড়ে এশিয়াতে এর বিস্তার ঘটে। ক্রমে এর ছোঁয়া এসে লাগে এই বাংলা এবং কলকাতাতেও। যদিও গোয়া থেকে এখানে ছাপাখানার ছোঁয়া পৌঁছোতে সময় লেগেছিল দুশো বাইশ বছর। যন্ত্রে ছাপা বইয়ের সূচনা হয়েছিল হুগলিতে৷ ১৭৭৮ সালে সেখান থেকেই ছেপে বের হয়েছিল ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হলহেডের 'জেন্টুল'৷
এর বাইশ বছর পরে হুগলির শ্রীরামপুর মিশনের প্রতিষ্ঠা হলো৷ ওই বছরই অর্থাৎ ১৮৮০ সালে মিশনের নিজস্ব ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় মলিয়ের রচিত 'মঙ্গল সমাচার', রামরাম বসু ও টমাসের অনুবাদে৷ যদিও সেইসময় কলকাতায় ছাপাখানা এসে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে তখন বের হতে শুরু করেছিল অগস্টাস হিকির ইংরেজি কাগজ ‘হিকিজ় বেঙ্গল গেজেট’।
তবে, এ কথা ঠিক যে, এদেশে ছাপাখানার পথিকৃৎ হল শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস৷ কারণ, বিষয়বৈচিত্র্য আর গুণগত উৎকর্ষ ছিল ওখানেই। সেই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে খোদাই করা বাংলা হরফের নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকারের নাম ৷
১৮০০ সাল একটি স্মরণীয় বছর৷ এই বছরেই ছাপাখানা আর লর্ড ওয়েলেসলির আগ্রহে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সূচনা৷ কিন্তু কলেজ তো হলো, ছাত্রদের পড়ার জন্য বাংলা বই কই? এই বইয়ের প্রয়োজন মেটাতেই ছাপা অক্ষরে বাংলা গদ্যের জন্ম। এই একটা বছরেই ছাপাখানার ওপর ভর করে একদিকে খুলে গেল বাংলা গ্রন্থ প্রকাশনা, আর অন্যদিকে বাংলা পত্রপত্রিকার বাজার৷ তবে বাংলা ছাপা বইয়ের একঘেয়েমি ঘোচে ১৮১৬ সালে। আর এর কৃতিত্ব লেখক ও সাংবাদিক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচাৰ্যর। এসে যায় লিথোগ্রাফিক ছবি৷
দেখতে দেখতে ঊনিশ শতক এসে পড়ল৷ ঘটল নিঃশব্দ বিপ্লব৷ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আবিষ্কার করলেন হাফটোন বা প্রসেস ব্লক বানানোর কলাকৌশল৷ পাতায় পাতায় ফুটে উঠল রঙিন ছবি ও ফটোগ্রাফি ৷ বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি পাঠকের হাতে পৌঁছে গেল রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’-র সচিত্র সংস্করণ, যা প্রধানত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতেই সাজানো৷
পাঠকদের মন্তব্য
250